সারাদিন অফিস করে মতিঝিল থেকে মিরপুরগামী লক্কড়-ঝক্কড় বাসে উঠে ঘুম দিতাম। ঘণ্টাখানেক পর ঘুম থেকে উঠে দেখতাম যানজটের কারণে বাস বাংলামোটর-কারওয়ান বাজারও পার হয়নি। তখন কী যে বিরক্ত লাগতো, তা বলে বোঝানো যাবে না। মেট্রোরেল চালুর পর স্বস্তি পেয়েছিলাম। সেই মেট্রোরেলে যাতায়াতেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো। এখন বাসে যাতায়াত আগের চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক মনে হচ্ছে।
সোমবার (২৯ জুলাই) কথাগুলো বলছিলেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে গোলাম রহমান। তার বাসা মিরপুরের কাজীপাড়ায়।
গোলাম রহমান বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠতাম। ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে স্টেশনে গেলে ১০ মিনিট পরপর মেট্রোরেল পেতাম। ২৫ মিনিটের মধ্যে মতিঝিল চলে যেতে পারতাম। অফিসে দেরি হওয়া বা গরম, ধুলাবালির ছোঁয়াই লাগতো না। কিন্তু কোটা আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলের কয়েকটি স্টেশন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করায় এখন যাত্রী পরিবহন বন্ধ। যাত্রীদের বাধ্য হয়ে বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে।’
গত ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর ও কাজীপাড়ায় মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এদিন বিকেল সাড়ে ৫টার পর থেকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ। কবে চালু হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত নেই।
সোমবার (২৯ জুলাই) মতিঝিল, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি স্টেশনের প্রবেশপথে তালা লাগানো দেখা গেছে। ফলে স্টেশন এলাকায় গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেক যাত্রী।
মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে বাংলামোটর মোড়ে নামেন বশিরুল হক। তার বোনের বাসা কাঁঠালবাগানে। আলাপকালে বশিরুল হক বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর প্রায়ই বোনের বাসায় বেড়াতে যেতাম। বোনও মেট্রোরেলে আমার বাসায় বেড়াতে যেত। যাতায়াতে কোনো ভোগান্তি ছিল না। কিন্তু অনেক দিন পর আজ যখন বাসে বোনের বাসায় যাচ্ছি, খুবই বিরক্ত লাগছে। মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে বাংলামোটর যেতে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লাগছে। অথচ মেট্রোতে ১৫ থেকে ২০ মিনিটেই কারওয়ান বাজার স্টেশনে চলে আসা যায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু করে দিলে যাত্রীদের উপকার হবে। গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলের কয়েকটি স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে। তখন থেকে নিরাপত্তা বিবেচনায় মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ। আপাতত মেট্রোরেল চালু হওয়ার বিষয়ে আমাদের কোনো টার্গেট নেই।- এমএন সিদ্দিক
সোমবার বেলা ১১টায় প্রেস ক্লাব স্টেশনের ফটকে যান বংশালের লতিফ তালুকদার। তার গন্তব্য ছিল উত্তরা উত্তর স্টেশন। কিন্তু স্টেশনের ফটকে তালা লাগানো দেখে তিনি ফিরে যান। এ সময় আলাপকালে লতিফ বলেন, ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই উত্তরা যেতে হয়। এই পথে মেট্রোরেল সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। কিন্তু এখন দেখি মেট্রোরেল বন্ধ। কবে নাগাদ চালু হবে তা কোথাও লেখা নেই।
শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে উত্তরা যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশার খোঁজ করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সকালে উত্তরার জসিমউদদীন রোড থেকে ৪শ টাকা ভাড়া দিয়ে শাহবাগ আসি। এখন উত্তরা যেতে ৬শ টাকা ভাড়া চাচ্ছে। অথচ মেট্রোরেল চালু থাকলে ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে উত্তরা যাওয়া যেত। রাস্তাঘাটের ধুলাবালি, যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।’
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর প্রতিদিন দুই লাখ ৭০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতো।
জানতে চাইলে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএন সিদ্দিক বলেন, ‘মেট্রোরেলে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের কারণে অল্পদিনে মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলের কয়েকটি স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে। তখন থেকে নিরাপত্তা বিবেচনায় মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ। আপাতত মেট্রোরেল চালু হওয়ার বিষয়ে আমাদের কোনো টার্গেট নেই।’
যাত্রীসেবায় দ্রুত মেট্রোরেল চালুর আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় এখনো ঢাকা স্থবির হয়ে আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। সচল ঢাকা এবং যাত্রীসেবায় দ্রুত সময়ে মেট্রোরেল চালু করা জরুরি। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে।’