নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে স্বাভাবিক জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী—সবাই লাগামহীনভাবে বাজারের সব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস, সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দায়ী।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষত ডলার সংকটের এই সময়ে পণ্য আমদানি এখনো পর্যাপ্ত নয়। দেশে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়লে আমদানি আরো কমতে পারে। এতে সরবরাহ সংকটে আমদানি পণ্যসহ দেশীয় পণ্যের দামও বাড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতি বাড়লেও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত দু-তিন বছরে ভোক্তার প্রকৃত আয় বাড়েনি। ভোক্তার আয় যে হারে বেড়েছে, এর চেয়ে বেশি বেড়েছে ব্যয়। এতে এখন নিম্ন আয়ের মানুষই শুধু নয়, মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
তিন বছর ধরে এই প্রবণতা চলায় ভোক্তাদের যেমন ঋণ নেওয়ার হার বেড়েছে, তেমনি তারা ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাও হারিয়েছে।
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে চার কোটি ১০ লাখ পরিবারের ২৬ শতাংশ মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে চলছে। অর্থসংকটে মৌলিক খাদ্য কেনা কমিয়ে দেওয়ায় দরিদ্র মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন তা প্রায় ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের মূল্য বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।
টাকার এই অবমূল্যায়ন ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে পণ্যের দাম। এরপর রয়েছে নিত্যপণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি।
বাজারসংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, ২০২০ সালের মার্চে কভিড পরিস্থিতি শুরু হওয়ায় দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। তখন মূল্যবৃদ্ধির কারণ ছিল ভোক্তাদের বেশি করে নিত্যপণ্য কেনা। ২০২০ ও ২০২১ সালে মূল্যস্ফীতি তবু লাগামছাড়া হয়নি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ফলে দেশে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, শিল্পের কাঁচামাল, পশুখাদ্যসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে, যা বাড়িয়ে দিয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
কিন্তু গত দুই বছরে প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম কমলেও বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে। বাংলাদেশে ভোগ্য পণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।
দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা কমানো যেত। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোরও আমদানির সক্ষমতা কমে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে ক্ষয় হচ্ছে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য মতে, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৭২ শতাংশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমানে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের চেয়ে বেশি।
জানতে চাইলে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়্যারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি সমন্বিততভাবে কাজ না করা। তবে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি সব সমাধান নয়। বাজার ব্যবস্থাপনাটা একটা বড় ভূমিকা রাখে। এটি দীর্ঘদিন ধরে বেসামাল। কোনোভাবেই বাজার ব্যবস্থাকে ভোক্তাবান্ধব করা যাচ্ছে না। যাঁরা বাজারে ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সুযোগসন্ধানী, যেন অতিমুনাফাই তাঁদের ব্যবসার মূল লক্ষ্য।’
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য আমরা কিছু সরকারি সংস্থার সার্ভেইল্যান্সকে (নজরদারি) যদি মনে করি তাহলে এটা ভুল হবে। বাজার ব্যবস্থা একটা সমন্বিত বিষয়। একটি পণ্য বাজারে আসতে তিন-চারটি মধ্যস্বত্বভোগীর হাত থাকে। এতে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে লোকবলের অভাবে ঠিকমতো বাজার নজরদারি করতে পারছে না সরকারের দায়িত্বরত সংস্থাগুলো।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক আমদানি করা খাদ্যপণ্য হাতে গোনা কয়েকজন বড় বড় ব্যবসায়ীর হাতে। ফলে তাঁদের মতো করে তাঁরা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সুতরাং বাজার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য যেসব উপাদান থাকা দরকার, সেসব উপাদান আমাদের বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। আমাদের পণ্যের উৎপাদন এবং চাহিদার সঠিক ও গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই, এটা ঠিক করা গেলেও বাজার ব্যবস্থায় অনেকটা ভূমিকা রাখা যাবে।’
মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘ভোক্তারা ন্যায্য দামে পণ্য পেতে চায়, কিন্তু তারা সেটি পাচ্ছে না। এটার বড় যে কারণ সেটাই হচ্ছে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত ও অপনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা। গত দু-তিন বছরে সাধারণ ভোক্তাদের আয় কিন্তু বাড়েনি। এই সময়ে কর্মহীন হয়েছে প্রচুর মানুষ, দারিদ্র্যসীমার নিচেও গেছে অনেক মানুষ। এ কারণে অনেক মানুষ এখন তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না।’
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাঝারি মানের চাল ব্রি-২৮ ও পাইজাম খুচরায় প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪৪ থেকে ৫০ টাকায়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুচরায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ১৮ থেকে ২৫ টাকায়, খোলা চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২৫ টাকায়। গত ২৮ জুলাই রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয় ১৪০ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ সক্ষমতাও বাড়তে হবে। যখন বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে, তখন যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। আমদানি করে হলেও বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।’