বঙ্গোপসাগরে তেল–গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ আরও পেছাচ্ছে। আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময় তিন মাস বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল বিগত সরকার। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা পেলে দরপত্রের মেয়াদ বাড়ানো হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়ে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর থেকে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বলছে, দরপত্রে অংশ নিতে ৫৫টি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে ছয়টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে। দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময় শেষ হচ্ছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর।
২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এরপর ২০১৯ সালে নতুন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। এরপর তিন বছর সময় নিয়ে নতুন পিএসসি–২০২৩ চূড়ান্ত করা হয়। গত ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এর আগে সবশেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১৬ সালে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গত বুধবার বলেন, দরপত্র আহ্বানের সময় তিন মাস বাড়ানোর প্রস্তাব জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে অনুমোদন নেওয়া আছে। এখন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টার সম্মতি নিয়ে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।
ইতিমধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ৯টি ব্লকে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবার আগের চেয়ে বেশ কিছু সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। দরপত্রে দেশের স্বার্থের পাশাপাশি বিনিয়োগকারী কোম্পানির স্বার্থও দেখা হয়েছে।
বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, ইতালির ইনি এসপিএ, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি ও ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে জানা গেছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ করে আগামী বছরের প্রথমার্ধে চুক্তি হতে পারে। এরপর নিজেদের প্রস্তুতি শেষ করে জাহাজ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনতে কয়েক মাস লেগে যাবে। তাই আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের পর বঙ্গোপসাগরে কাজ শুরু হতে পারে। তবে কেউ কেউ বলছেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে সমুদ্রে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে ২০২৬ সালও হতে পারে।
গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি মিলে মোট ২৬টি ব্লক আছে বঙ্গোপসাগরে। এর মধ্যে ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে দুটি ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ চালালেও পরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া একইভাবে চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। এখন একমাত্র কোম্পানি হিসেবে অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি।
পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চুক্তি অনুসারে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে ওএনজিসির। একটি কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি তারা। আরেকটি কূপ খনন করার কথা। পরিকল্পনার চেয়ে বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। কূপ খননে তিনবার দরপত্র ডেকে প্রতিবারই অস্বাভাবিক দর পেয়েছে। তাই তারা এখনো মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করেনি। ফেব্রুয়ারির পর চলে যেতে পারে তারা।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, সমুদ্রে প্রাথমিক সম্ভাবনা যাচাই করতে জার্মানির কোম্পানি স্লামবার্জারকে দিয়ে বহুমাত্রিক জরিপ চালানো হয়েছে। এ জরিপের তথ্য কিনে নিতে পারবে দরপত্রে আগ্রহী যেকোনো কোম্পানি। এ ছাড়া কনোকোফিলিপসের পরিচালিত দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্যও আছে পেট্রোবাংলার কাছে। এতেও গ্যাসের সম্ভাবনা দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে। যদিও অনুসন্ধান কূপ খনন ছাড়া উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করা যায় না। এখন পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে কোনো কূপ খনন করা হয়নি। তবে একই সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিদেশি কোম্পানি আসতে চায় না। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তিন মাস সময় বাড়ালে হয়তো ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। তাই এরপর আর মেয়াদ বাড়ানো ঠিক হবে না।