প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার কয়েকদিন আগে শেখ হাসিনা সবশেষ সংবাদ সম্মেলনে তার এক পিয়নের ‘৪০০ কোটি টাকার মালিক’ হওয়ার যে তথ্য দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তির ‘বিপুল সম্পদ’ অবৈধভাবে অর্জনের তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নিজেই অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে, পিয়ন। সেও এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না…।’ এই বক্তব্যটি তখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
দুদক বলছে, নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহারখিল গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম নিম্নবিত্ত পরিবারের। জাতীয় সংসদে দৈনিক মজুরিতে কাজ করতেন। তিনি অর্থবিত্তের মালিক হতে শুরু করেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সবশেষ দ্বাদশ সংসদে নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। হলফনামায় তিনি নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য দেন। স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য দেন।
“জাহাঙ্গীর নিজের নামে সাড়ে ৪ একরের বেশি কৃষিজমি, ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে সাততলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে একতলা ভবন ও মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন (দাম ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা)। এছাড়া চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। স্ত্রীর নামে ঢাকার ধানমন্ডিতে ২ হাজার ৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। জাহাঙ্গীর পরিবারের একটি আটতলা বাড়ি রয়েছে নোয়াখালীর মাইজদীর হরিনারায়ণপুর এলাকায়। বাড়িটিতে ১৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৮টি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, “তিনতলার একটি ফ্ল্যাট ব্যবহার করেন জাহাঙ্গীরের পরিবার। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ টাকা ও ব্যাংকে মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা এবং স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংকে স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
“এ ছাড়া স্ত্রীর নামে একটি গাড়ি আছে, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয় ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অংশীদারী ফার্মে তার মূলধন ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা। জাহাঙ্গীর ‘একে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড’ নামক ডেভলপমেন্ট কোম্পানির মালিক।
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগটি দুদকের উপপরিচালক মো. জাহিদ কালাম প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সুপারিশ করে গোপন প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনের ওপর আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য বলা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার তুমুল গণআন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। আন্দোলন জোড়ালো হওয়ার আগে চীন সফরে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেখান থেকে ফিরে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সহকারীর প্রসঙ্গটি সামনে আনেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা…জানতে পেরেছি, পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে সেই ‘পিওনের’ নামোল্লেখ না করলেও পরে জাহাঙ্গীর, তার স্ত্রী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সেইসঙ্গে তাদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য পাঠাতে ব্যাংক সমূহকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
নির্দেশনায় জাহাঙ্গীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে কোনো হিসাব থাকলে সেসব হিসাবের লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩(১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখতে বলা হয়।
জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার ‘ব্যক্তিগত স্টাফ’ হিসেবে কাজ করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেওয়া হত, সেটা বহন করতেন জাহাঙ্গীর। সে কারণে তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে পরিচিতি পান।