টাকা ব্যাংকে ফেরত আনাই বড় চ্যালেঞ্জ

বানিজ্য

ছয় মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তৎকালীন ক্ষমতাশালীরা টাকা ব্যাংকে রাখছেন না: ড. জাহিদ হোসেন।

গত ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে বাসাবাড়িতে বা নিজের কাছে রাখার প্রবণতা বেড়েছে অনেক। ফলে অবৈধ বা বৈধ যাই হোক না কেন, টাকা নিজের কাছে রাখতে এখন বাসাবাড়ির জন্য সিন্দুক, লকার ও আলমারি কিনছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ টাকা লুকিয়ে রাখতে স্বভাবজাত প্রবণতার অংশ হিসেবে মানুষ টাকা রাখে গোপন জায়গায়। সে বিবেচনায় বাসাবাড়িতে সিন্দুকের ব্যবহার বাড়তে পারে। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের অন্যতম কারণও হতে পারে সিন্দুকে টাকা রাখার প্রবণতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ মোটা দাগে তিনটি হতে পারে। প্রথমত, ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। ফলে মানুষের হাতে তুলনামূলক বেশি টাকা রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা ব্যাংকে জমা না হওয়া। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কয়েক জন ব্যক্তির দুর্নীতি-ঘুষবাণিজ্য সামনে আসায় অনেকে সতর্ক হয়ে টাকা হাতে ধরে রাখছেন। তৃতীয়ত, ব্যাংকে জমা টাকা সময়মতো ফেরত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে আস্থাহীনতা  রয়েছে।

অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা সরানো হচ্ছে

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বৈধ ও অবৈধ দুই ধরনের অর্থই কিছু মানুষ ব্যক্তিগত সিন্দুকে রাখছেন। এর দুই ধরনের কারণ আছে। প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে মানুষ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার আস্থাটা এখনো গড়ে ওঠেনি। যেমন—মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে কি না; এটিএম বুথে টাকা থাকবে কি না; এ ধরনের ভীতি থেকে বাসায় সিন্দুকে টাকা রাখার প্রবণতা স্বাভাবিক। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়, অর্থনীতির চাকা সচল হয়ে আসে, তাহলে ব্যাংকিং খাতে অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সিন্দুকে টাকা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। কারণ সিন্দুকে টাকা রাখার ঝুঁকিও আছে। পোকায় খেয়ে ফেলতে পারে। ডাকাতিও হতে পারে। অনিশ্চয়তা কেটে গেলে, মানুষ বাসা থেকে বের হতে পারলে, এটিএমে বুথে টাকা পেলে, ইন্টারনেট সচল থাকলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সাধারণ মানুষ সিন্দুকে টাকা রাখার প্রয়োজনবোধ করবেন না।

দ্বিতীয় কারণ, ক্ষমতার একটি পরিবর্তন ঘটেছে। তৎকালীন ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তাদের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন। তারা ব্যাংকে টাকা রাখছেন না। কারণ ব্যাংকে রাখলে টাকা জব্দ করা সহজ। সেক্ষেত্রে একটি ভালো সিন্দুক কিনে মাটির নিচে পুঁতে রাখলে সেখানে পোকা ঢুকতে পারবে না, পানিও ঢুকতে পারবে না। সেখানে ব্যাংকের চেয়ে একটু নিরাপদ থাকে। আর যদি সুসময় আসে সিন্দুক থেকে টাকা বের হয়ে আসবে। আমরা শুনছি, এ একবিংশ শতাব্দীতে বস্তায় বস্তায় টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো আইনের আওতায় এনে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে।

বংশালের কয়েক জন সিন্দুক ব্যবসায়ী জানান, মুঘল আমল থেকে এ জনপদে সিন্দুকের ব্যবহার হয়ে আসছে। বনেদী পরিবার এবং কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এসব সিন্দুক রাখত। ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী, তারা সিন্দুক তৈরি করেন। সিন্দুক বিক্রির কোনো মৌসুম নেই। সাধারণত সোনা ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন এজেন্ট, ব্যাংক তাদের কাছ থেকে সিন্দুক কেনে। তবে বর্তমানে সাধারণ মানুষও বাসাবাড়িতে সিন্দুক ব্যবহার শুরু করেছে। সিন্দুক, লকার কিনছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ২০ বছরের মধ্যে শেষ ১০ বছরে সিন্দুকের বেচাকেনা বেড়েছে দ্বিগুণ। আর শেষ পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ডিজিটাল সিন্দুকের চাহিদা। একটা সময় শুধু রাজধানীর বংশালে সিন্দুকের বেচাকেনা থাকলেও এখন ঢাকার কলাবাগান-উত্তরাসহ চট্টগ্রাম-সিলেটের মতো বড় বড় শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে সিন্দুকের বড় বড় দোকান।

এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইত্তেফাককে বলেন, অনেকেই দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন। এই টাকা তারা ব্যাংকে রাখতে পারছেন না। তারা এই টাকা বাসায় সিন্দুকে, লকারে রাখছেন। ব্যাংকে টাকা রাখলে এই টাকা একটা হিসাবের আওতার মধ্যে পড়বে।

বেসরকারি ব্যাংকের আরেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা আরও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে বেশির ভাগ এটিএম বুথ বন্ধ রাখা হয়। আবার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ডিজিটাল লেনদেন হয়নি। অস্থিরতার কারণে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অনেকেই এখন হাতে তুলনামূলকভাবে বেশি টাকা রাখেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি সূত্র জানায়, সবাই যে অবৈধ টাকা বাসার সিন্দুকে বা লকারে রাখছেন, এটা সব সময় ঠিক না-ও হতে পারে। তবে এই টাকার উৎস কী—এটা জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকলে দুদক ব্যবস্থা নেবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুর্নীতির টাকার লেনদেন সব সময় নগদ অর্থে হয়। এই টাকার হিসাব থাকে না আয়কর ফাইলে। তাই টাকাগুলো ব্যাংকে রাখলে নানারকম জবাবদিহির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য মানুষ এই টাকা বাসায় রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর এই টাকাই দেশের বাইরে পাচার হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *