অস্থিরতার মুখে বাংলাদেশের অর্ডার কমিয়েছে গ্লোবাল ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো

বানিজ্য

কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের নির্মাতারা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর শেখ হাসিনার সরকারের নির্মম দমন-পীড়নের পর কয়েকদিনের জন্য কারখানা বন্ধ ছিল। সুইডিশ খুচরা বিক্রেতা এইচ অ্যান্ড এম এবং স্প্যানিশ চেইন জারার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের সরবরাহকারীসহ শাসকগোষ্ঠীর অনুগতদের মালিকানাধীন একাধিক কারখানা প্রতিশোধমূলক হামলায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা সহিংসতায় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় শীতকালীন খুচরা মৌসুমে জামাকাপড় ও জুতা সরবরাহ বিলম্বিত হয়েছে।

বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, কিছু বড় ব্র্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরবরাহকারীদের কাছে আসন্ন মৌসুমের জন্য অর্ডার স্থানান্তর করেছে, যা বিদ্যমান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করেছে।

বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের উপদেষ্টা মামুন রশিদ বলেন, কারখানাগুলো স্প্যানিশ ক্রেতা ও জার্মান ক্রেতাদের কাছ থেকে ফোন পেয়েছে। আপাতত আমরা আমাদের অর্ডারের ৪০ শতাংশ কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় সরিয়ে নিচ্ছি।

ফরাসি ক্রীড়া খুচরা বিক্রেতা ডেকাথলন এবং ইউনিক্লোর জাপানি প্যারেন্ট ফাস্ট রিটেইলিং সরবরাহকারী অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, এই অস্থিরতা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ‘সত্যিকারের আস্থায় নাড়া দিয়েছে’।

বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মঞ্জুর বলেন, বড় গ্রুপগুলো বলছে- আগামী মৌসুমের জন্য তাদের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আস্থা ফিরে এসেছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

কর্তৃপক্ষ একটি নতুন শিল্প নিরাপত্তা টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং কারখানাগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। সাবেক সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে থাকা পুলিশ চলতি সপ্তাহ থেকে কাজে ফিরতে শুরু করেছে।

শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ব্যবসা সহজীকরণ, সড়ক, বন্দর ও ডিজিটাইজেশনে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বিশ্বের অনেক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের ওপর ভরসা করেছে। উদাহরণস্বরূপ- এইচঅ্যান্ডএমের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশভিত্তিক সরবরাহকারীদের জন্য এক হাজারেরও বেশি এন্ট্রি রয়েছে। বাংলাদেশ গত বছর ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে এবং জুতা ও চামড়াজাত পণ্যেরও বড় উৎপাদক।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রপ্তানি শিল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনগুলো তার অনুগতদের দ্বারা আধিপত্য ছিল এবং বিজনেস ম্যাগনেটরা তার সরকারের সিনিয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিল। সমালোচকরা বলেছিলেন যে, এর ফলে তারা দায়মুক্তির সাথে কাজ করতে পারেছে- এমনকি ব্যাংক ঋণ খেলাপি করে।

এইচঅ্যান্ডএম ও জারা সরবরাহকারী এক কারখানা মালিক বলেন, অনেকেই তাকে (শেখ হাসিনা) খুশি করার জন্য…যাতে তারা পরে মন্ত্রী, মেয়র হতে পারেন এবং আওয়ামী লীগের কমিটিতেও স্থান পেতে পারেন। কাস্টমস লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে ঘুষ হিসেবে ‘মোটা অঙ্কের অর্থ’ দিতে হয়েছে।

ইউনূস সরকার বলেছে, তারা দুর্নীতি দমন করতে চায় এবং আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে চায়, যা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে সহায়তা করবে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক শিল্প উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকার উপকণ্ঠে বেক্সিমকো পরিচালিত একটি কারখানায় গত সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায়।

সুইডিশ ক্লোজিং গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা আমাদের সরবরাহকারীদের জানিয়েছি যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিলম্বের কারণে আমরা কোনো ছাড় চাইবো না।

ইউনিক্লো বাংলাদেশ থেকে অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও সূত্র বলেছে, তারা ‘কারখানার আগাম সম্মতি ছাড়া’ অর্ডারগুলো বাতিল করেনি। জারা এবং ডেকাথলন মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে আশ্বস্ত করতে পারবেন বলে তারা আশা করা হচ্ছে।

এপেক্সের মনজুর বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত’। অর্থনীতি অনেক গতি হারিয়েছে, যা প্রথম সুযোগেই পুনরুদ্ধার করতে হবে।

এপেক্সের স্পোর্টস ইউনিটের প্রোডাকশন হেড নওশীন ইসলাম বলেন, আমরা সবাই সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তিনি স্বীকার করেছেন যে দেশের পরিস্থিতি অনিশ্চিত, তবে তিনি যোগ করেছেন, ‘আমি মনে করি আমরা খুব শিগগিরই এটি কাটিয়ে উঠব। আমি ভবিষ্যতের জন্য খুবই ইতিবাচক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *