শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের কারণে বাংলাদেশের অবস্থা বেশ পাল্টে গেছে। এই পরিবর্তন ভারতের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত, এর মধ্যে আছে ভারতের কৌশলগত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলও।
শেখ হাসিনার সরকার ভারতীয় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং গত ১৫ বছরে নিরাপত্তা, সংযোগ, বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। ভারতও বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সফট লোন দিয়েছে, যা ভারতের জন্য কোনও একক উন্নয়ন সহযোগীর জন্য সবচেয়ে বড় পরিমাণ ঋণ।
এই সম্পর্ক উভয় দেশের জন্যই লাভজনক ছিল। শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্জীবিত করেছিল, যেখানে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাহিনী মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল। ধর্মীয় সম্প্রীতির উপর জোর দিয়েছিল, যা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের বার্তা দিয়েছিল।
শেখ হাসিনার আমলে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুস্থিতি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে, যার ফলে দেশটি স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে হওয়ার দিকে গেছে। তারপরও জনগণের অসন্তোষ এবং পরিবর্তনের আন্দোলনের জেরে সরকারের পতন ঘটে।
একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়নি। বরং এর জন্য দায়ী ক্ষমতায় থাকার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের ওপর নির্ভরতা, গণতন্ত্রের অবক্ষয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং কোভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনা- যা পরস্পর নির্ভরশীল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
ক্ষমতায় থাকার জন্য হাসিনা সরকার আরও অধিকতর সহজ পন্থা অবলম্বন করলে ভারত বেশি খুশি হতো। এর মধ্যে একটি হতে পারতো ভোট আকর্ষণে তার সরকারের ইতিবাচক কাজগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা।
অনিশ্চয়তা: সরকারের পতনের পর স্থিতিশীল প্রশাসন ছাড়াই এক সপ্তাহ কেটে গেছে। তবে এরই মধ্যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণ করলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, ভাঙচুর, লুটপাট, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী ক্যাডারদের উপর হামলা- এগুলো ছাত্ররা করেনি; মনে হয় এসব হচ্ছে আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী অপশক্তির কাজ। বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় ৪২ জন পুলিশ সদস্যের প্রাণ গেছে। এতে মনোবল হারিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে পুলিশ বাহিনী। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজে ফিরবে না বললেও সোমবার তারা কাজে ফিরেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। তারা বরং পাশে থেকে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহিংসতা বন্ধ এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলা বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ এখন কোন পথে, ক্ষমতার চাবিকাঠি কে নিয়ন্ত্রণ করছে- এসব বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। তথ্য রয়েছে যে, নতুন দৃশ্যবলী উপস্থাপনার নেপথ্যে প্রভাবক হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াত-ই-ইসলামী।
যদিও বিকল্প খুবই কম, তবে ভারতকে মন্দের ভালোটাই বেছে নিতে হবে। তা হলো- বাংলাদেশে যারা আড়ালে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছে তাদের সঙ্গে নয়, যারা ক্ষমতায় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে।
দুই উদ্বেগ: ভারতের দুটি প্রধান উদ্বেগ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ভূখ- ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেন কোনওভাবে ব্যবহার না হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে তার অভিনন্দন বার্তায় উদ্বেগের বিষয়গুলোর উল্লেখ করেছেন।
উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে বাণিজ্য, সংযোগ এবং উন্নয়নমূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার কাজ চালিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতকে স্পষ্ট করতে হবে যে, সে পক্ষপাতমূলক স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট নয়; নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাকে সে অগ্রাধিকার দেয়।
নতুন এই সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারগুলো যেমন- শান্তি, নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি- ইত্যাদি বিষয়গুলো সমর্থন করার মাধ্যমে ভারত সুস্পর্ক গড়তে সম্ভাবনার নতুন পদক্ষেপ নিতে পারে।
যে বিক্ষোভে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, এর নেপথ্য কারণগুলোর মধ্যে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট অন্যতম। নতুন অনির্বাচিত এই অন্তর্র্বতী সরকারকে জনগণের সমর্থন পেতে এসব বিষয় সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যাতে ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে পাে সেজন্য অন্তরবর্তী সরকারকে রুপি ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারে ভারত। সেই সঙ্গে অনুদানের ভিত্তিতে দ্রুত আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে; এর মধ্যে থাকতে পারে ছাত্র নেতাদেরসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভারতে আমন্ত্রণ জানানো; এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জাপানের মতো বাংলাদেশে অংশীদারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করা।