অভিভাবকহীনতা : ব্যাংক খাতে বড় চ্যালেঞ্জ

বানিজ্য

সরকার পতনের চার দিনের মাথায় পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এখন অভিভাবকহীন।

তারও এক দিন আগে চার ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউয়ের প্রধানকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। যদিও কাগজে-কলমে এখনো পদত্যাগ করেননি তাঁরা।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, অধিকার আদায়ে উত্তাল পুরো ব্যাংক খাত। নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার।

এ অবস্থায় গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করা যাবে না। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ এখানে এখন কেউ নেই। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে অরাজকতা বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরো জানান, দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকানা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন, নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে যাতে কেউ টাকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছু ব্যাংকে পাল্টা নিয়ন্ত্রণের ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার এসআইবিএলে গিয়ে আগের পরিচালকরা নিয়ন্ত্রণ নেন। ইউসিবির বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে শেয়ারহোল্ডারদের একটি অংশ। কিছুদিন আগে মালিকানা বদল হওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকে আবারও মালিকানা বদলের গুঞ্জন উঠেছে। এদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকরা পালিয়ে আছেন। সব মিলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ওয়ান, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা ও ইনসেনটিভের দাবিতে গতকাল রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের সুবিধা দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি হতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। কমিশনের (ঘুষ) বিনিময়ে তাঁরা ব্যবসায়ীদের কত টাকার সুবিধা দিয়েছেন ও কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তার প্রমাণ থাকা দরকার। উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না করলে আবারও এ রকম অপরাধের পুনরাবৃত্তি হবে।

আহসান এইচ মনসুরের মতে, ব্যাংক খাতের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তাই এখন ব্যাংকিং খাতের একটা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা দরকার। প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩০ থেকে ৪০টি ব্যাংকের সঙ্গে বসে ব্যাংকের ক্ষতস্থান চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ‘বাংলাদেশের আইন-কানুন যথেষ্ট আন্তর্জাতিকমানের। কিন্তু এত দিন সেটা মানা হয়নি। যারা মানাবে (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) তারা মানেনি। যারা মানবে তারাও মানেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর (আব্দুর রউফ তালুকদার) পদত্যাগ করে দূর্নীতি থেকে দায়মুক্ত হয়ে গেলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা আইন ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয় আমরা ব্যবস্থা নেব।’

আব্দুর রউফ তালুকদারের পদত্যাগপত্র গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করতে হয়। এ বিষয়ে আগামীকাল মিটিং আছে, সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *