নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনায় জোরালো ভূমিকা রাখবেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুরোনো ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ডে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিটি উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ককে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার পাশাপাশি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একজন প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের সর্বস্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান কালবেলাকে বলেন, যে দুজন শিক্ষার্থীকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। হয়তো সে কারণেই মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য আরও অনেককে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের প্রতিমন্ত্রী বা অন্য মর্যাদা দিলে সেখানেও প্রভাব বা আধিপত্য বিষয়টি চলে আসতে পারে। যেহেতু এবারের গণঅভ্যুত্থান আগের মতো নয়, তাই বাস্তবতাও ভিন্ন। তবে শিক্ষার্থীরা সহকারী উপদেষ্টা হলে সেটি তাদের জন্য লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স হবে। তারা সামনে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা দেখতে পাবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের কীভাবে যুক্ত করা হবে, সে সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়নি। সে কারণে তারা কী করবে, কীভাবে করবে তা—জানি না। বিস্তারিত জানালে বিষয়টি নিয়ে আরও সুস্পষ্ট করে কথা বলা যাবে। তারা ব্যর্থ হবে না সফল, তা তাদের কাজের ধারা অনুযায়ীই বলা যাবে।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সামগ্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল। তারা যে ধরনের চিন্তা ও প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন করেছেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে এই অর্জন ধরে রাখা যাবে না। এ কারণে সরকারের কর্মকাণ্ডে আন্দোলনের সংগঠকদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা চালু করা গেলে দেশের বিভিন্ন সমস্যার বাস্তব চিত্র উঠে আসবে এবং সমাধান করা সম্ভব হবে বলেও মনে করছেন তারা।
গত বৃহস্পতিবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। সেখানে তরুণ সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের দুই নেতা মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এর মধ্যে নাহিদ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং আসিফ যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
গত শুক্রবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বৈঠকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কাজে আন্দোলনকারীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানান, ‘ছাত্রসমাজ দেশের একটি বড় শক্তি। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা তাদেরও কাজের সুযোগ দিতে চাই। এ লক্ষ্যে উপদেষ্টাদের সঙ্গে ‘সহকারী উপদেষ্টা’ পদ সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ তৈরি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রাথমিকভাবে কিছু কাজ হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি শান্ত হলে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নাহিদ বলেন, ‘বড় বড় দলও অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সে জায়গায় ছাত্রসমাজের মাধ্যমেই একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এই ছাত্রদের ওপর আস্থা রেখেই জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। ছাত্রসমাজই যেহেতু সরকার এবং রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কথা বলছে, সাধারণ জনগণও তাদের ওপর আস্থা রাখবে।’
সরকারের কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সব মন্ত্রণালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্দোলনকারী ছাত্র প্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত থাকবেন। তবে কীভাবে বা কোন কাঠামোয় তাদের যুক্ত করা হবে—তা পরে ঠিক করা হবে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত সময়েও সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই গণঅভ্যুত্থান ছিল রাজনৈতিক দলের। এবারই প্রথম ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও নেতৃত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের হাতেই। তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও ছিল সামনের কাতারে। সে কারণে এই অভ্যুত্থানের বাস্তবতা ভিন্ন। ছাত্ররা একটি পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। রাষ্ট্র সংস্কার করতে চেয়েছিল। এখন তারা সেই সুযোগ পেয়েছে।
তারা বলেন, ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি সরকারে গেছেন। বাকিরাও বসে নেই। তারা দলে দলে ভাগ হয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে; ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলা ঠেকাতে সেগুলো পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আরেক দল বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং টিমের মাধ্যমে কাজ করছে। এসব উদ্যোগই প্রমাণ করে, ছাত্ররা দেশের কল্যাণ চায়। ঘুণে ধরা ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সে কারণে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। এই শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমে সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ পেলে তা অবশ্যই ইতিবাচক হবে। কারণ মাত্র দুজন উপদেষ্টার পক্ষে সবসময় সব কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই প্রক্রিয়া আরও শিক্ষার্থী যুক্ত করা হলে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া গতিশীল হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রভাষক খন্দকার রুবাইয়াত মুরসালিন কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারে তরুণদের অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের মতামত প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ দেবে। একই সঙ্গে সরকারের জবাবদিহির জায়গাটিও নিশ্চিত হবে। নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্নে আমরা একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আগামী দিনে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে তরুণ নেতৃত্বই সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত।’
তিনি বলেন, ‘আমি এখনই তাদের নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখতে চাই না। এটিকে বরং একটি ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরোর প্রসেস’ হিসেবে দেখতে চাই। তাদের সফলতার ওপর আগামীর বাংলাদেশের ভিত রচিত হবে। তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মূলধারার রাজনীতিতে আরও বেশি তরুণ অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের সহকারী উপদেষ্টা করা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরেও পর্যালোচনা চলছে। তবে সেটি একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনো কোনো পর্যায়ে পৌঁছেনি।
জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা সহকারী উপদেষ্টা হিসেবে থাকলে ভালোই হবে। এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। কারণ বর্তমান তরুণ সমাজ অনেক বেশি পরিণত (ম্যাচিউরড)। তারা যে কোনো সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। বিগত সময়ে বিভিন্ন খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, সেটি পূরণে সহ-উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাহবুব জোবায়ের কালবেলাকে বলেন, বিগত সময়ের সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রী-এমপি কিংবা উপদেষ্টাদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। সে কারণে অনেক অভাব-অভিযোগের বিষয়ে সাধারণ মানুষ কোনো সমাধান পায়নি। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা হয়েছে, এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পাশাপাশি সহ-উপদেষ্টা হিসেবে যদি শিক্ষার্থীদের রাখা হয়, তাহলে তারা জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে। কারণ তারাই এসব সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। এর ফলে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যাবে, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত যাতে না নেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি।