দেশের তরুণদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষিত তরুণদের ৪২ শতাংশই বিদেশ যেতে আগ্রহী। এর মধ্যে সেসব শিক্ষার্থীও রয়েছেন, যারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে যেতে যান। মূলত দেশে শিক্ষার্থীদের অত্যাধিক লেখাপড়ার ব্যয়, পড়ালেখার পাশাপাশি রোজগারের পথ না থাকা, পড়ালেখা শেষে সময়মতো চাকরি না পাওয়া কিংবা চাকরির পয়সায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে না পারাই এর কারণ। ফলে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় তরুণরা বিদেশ পাড়ি দিতে চান। এর মধ্যে আবার বেশির ভাগই আর দেশে ফিরতে চান না।
গত বছর বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। দেশের আট বিভাগের ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ-তরুণীর মধ্যে পরিচালিত ঐ জরিপ বলছে, শিক্ষিত তরুণদের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বা ৪২ শতাংশ দেশ ছাড়তে চান। এর কারণ হিসেবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, তাদের দক্ষতা অনুযায়ী দেশে চাকরি নেই।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের বাইরে মাস্টার্স করতে যাব এবং সেখানেই থেকে যাব। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পাশ করার পর হয়তো চাকরি পাব, কিন্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পাব না। এই টাকা বেতনে নিজের খরচ হয়তো চলবে টেনেটুনে। কিন্তু আমার বাবা-মা আছে, ছোট একটা বোন আছে, তাদের দায়িত্ব কি করে নেব এই বেতনে? ফলে দেশের বাইরে যেতেই হবে। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে বেশির ভাগ মানুষের ভালো লাগে না, কিন্তু যারা যায়, তারা বাধ্য হয়েই যায়।’
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ-এর শিক্ষার্থী মাহাজাবিন রহমান বলেন, ‘আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, বাবা অনেক কষ্টে আমাকে টাকা পাঠায়, কিন্তু আমি যদি দেশের বাইরে পড়তাম, তাহলে পার্টটাইম কাজ করে এই পড়ার খরচ চালাতে পারতাম। আমাদের দেশে যেটা সম্ভব নয়। আমি দুই জন ছাত্রকে পড়াই, এতে যে টাকা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে আমার হাত খরচ চলে, এর চেয়ে বেশি কিছু হয় না। যে কারণে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।’
রাইসা বিনতে হাসান আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ করেছেন, এখন দেশের বাইরে চলে যাবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যই বিদেশে যাচ্ছি। আমি মনে করি, আমাদের দেশে লেখাপড়া শেষ করেও ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্যই বিদেশ যাওয়া।’
এছাড়া সমাজের রন্ধে রন্ধে দুর্নীতি, চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা, অস্বাস্থ্যকর বায়ু, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সড়কে বিশৃঙ্খলা—এসব কারণেও দেশ ছাড়তে চান বলে জানান বিদেশ পাড়ি দেওয়া শিক্ষার্থীরা। রাইসা কিংবা মাহাজাবিনের মতো হাজারো তরুণ এখন বিদেশে যাওয়ার আশায় ভিড় করছেন ভিসা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী।
২০২২ সালে অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৪৪ হাজার ২৪৪ জন, ২০২০ সালে ৫০ হাজার ৭৮, ২০১৯ সালে ৫৭ হাজার ৯২০ এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ১৯১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেস প্রতিষ্ঠান ‘এক্সপার্ট এডুকেশন অ্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা সার্ভিস’-এর এক কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যদি কম টাকায় বিদেশ যাওয়া যেত, তাহলে হয়তো অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যেত। এত ব্যয়বহুল হওয়ার পরেও মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়ি বা অন্য সব সম্পত্তির বিনিময়ে বিদেশ যেতে চাইছেন। তিনি বলেন, গুটি কয়েক পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ভালো নয়, শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না, ফলে তারা বিদেশ পাড়ি দিতে চাইছেন। বিদেশে শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম কাজ করার সুযোগ থাকে এবং একটা ডিগ্রি নিলে ঐ রিলেটেড কাজ পান তারা; যার আয় ঐ পরিবারগুলোর জন্য সন্তোষজনক। তাছাড়া একজন বিদেশ গেলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সেই সুযোগটা তৈরি হয় এবং দেশে থাকা পরিবারের কাছে তারা আশানুরূপ আর্থিক সহায়তা দিতে পারেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে বর্তমান বেকারত্বের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ৪০ হাজার আর নারী ১৭ লাখ ১০ হাজার। নারী বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৫০ হাজার।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামছুল আলম বলেন, হতাশা থেকে আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিদেশমুখী হচ্ছে। দেশে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এর জন্য দায়ী। চাকরির নিয়োগে প্রশ্ন ফাঁস, রাজনৈতিক পরিচয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য রয়েছে। যার কারণে কিছু টাকা খরচ করে হলেও নিম্ম থেকে উচ্চবিত্ত সব ধরনের শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সেখানে তাদের ভালো শিক্ষা, গবেষণা ও দক্ষতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে বেশি নজর দিতে হবে।