কোথা থেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ সমালোচিতরা

বাংলাদেশ

ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর আত্মগোপনে আছেন সাবেক মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত ব্যক্তিরাও। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হচ্ছেন। ঢাকায় এখন পর্যন্ত ছয় আলোচিত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও একজন সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাও আছেন। এই ছয় জনের দুজনকে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগের সময় আটকে দেওয়া হয়েছে বলে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ভিন্ন স্থান থেকে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, আটক হওয়া ব্যক্তিরা কোথা থেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন?

তবে কোন পর্যায়ের ব্যক্তিরা আশ্রয় পেয়েছেন, সে বিষয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। ফলে হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা হলে তাকে কীভাবে আইনের আওতায় নেওয়া হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট করে জানা যায়নি।

তবে রোববার (১৮ আগস্ট) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রাণরক্ষায় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ মোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ৬১৫ জন নিজ উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে ৪ জনকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে সাতজন সেনানিবাসে অবস্থান করছেন।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সেনা হেফাজতে নেওয়াসংক্রান্ত বিষয়ে ১৩ আগস্ট রাজশাহী সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, ‘কারও যদি জীবন বিপন্ন হয়, ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে, অবশ্যই আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। তাদের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, মামলা হয়, অবশ্যই তারা শাস্তির আওতায় যাবেন। কিন্তু অবশ্যই আমরা চাইব না যে বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ হোক, হামলা হোক। তাদের জীবনের যে হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি।

তবে কোন পর্যায়ের ব্যক্তিরা আশ্রয় পেয়েছেন, সে বিষয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। ফলে হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা হলে তাকে কীভাবে আইনের আওতায় নেওয়া হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট করে জানা যায়নি।

পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কাছে শনিবার (১৭ আগস্ট) বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তারা বলেছে, সেনাপ্রধান ইতোপূর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তাই এ নিয়ে তাদের আলাদা কোনো বক্তব্য নেই।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্‌মেদ পলক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।

আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ১৩ আগস্ট জানানো হয়েছিল, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নৌপথে পলায়নরত অবস্থায় রাজধানী ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে এই দুজনকে নিউমার্কেট থানার মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হয়, আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে আগেই আটক করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার দেখানো হয় পরে।

এখন পুরো পরিস্থিতিই অস্বাভাবিক। সে কারণে হয়তো এমন কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে মামলার স্বার্থে, সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে আসামি গ্রেপ্তার ও আলামত জব্দের প্রতিটি বিষয় সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।

১৪ আগস্ট সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্‌মেদ পলক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তারের খবর জানায় ডিএমপি। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক তার ব্যক্তিগত দুজন কর্মকর্তাকে নিয়ে দেশত্যাগের জন্য ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। সে সময় তাকে বিমানে উঠতে না দিয়ে ইমিগ্রেশন হেফাজতে আটকে রাখা হয়, সে খবর তখন গণমাধ্যমে প্রচারও হয়েছিল। একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদকে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকে তারা কোথায় ছিলেন, তা আর জানা যায়নি। আটদিন পর পলক ও সৈকতকে গ্রেপ্তার করা হলেও রিয়াজের অবস্থান সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি।

ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনারকে একাধিকবার কল করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার হন সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি সর্বশেষ টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক ছিলেন। ১৬ আগস্ট বেলা ১টা ৫৪টা মিনিটে ডিএমপি গণমাধ্যমকে জানায়, নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে ১৫ আগস্ট গভীর রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে ডিএমপির পক্ষ থেকে সংশোধনী দিয়ে বলা হয়, জিয়াউল আহসানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় সেনাবাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করলে ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

যদিও জিয়াউল আহসানকে আদালতে হাজির করে যে রিমান্ড আবেদন করা হয় তাতে পুলিশ বলেছে, ১৬ আগস্ট রাজধানীর ৩০০ ফিট সংলগ্ন খিলক্ষেত থানা এলাকা থেকে অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটক করা হয়েছে।

সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনকে সাদা পোশাকে পুলিশের একদল সদস্য আটক করে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। শুক্রবার (আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টায় তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

রমেশ চন্দ্র সেনের স্ত্রী অঞ্জলি সেন অভিযোগ করে বলেন, সাদা পোশাকে পুলিশের ১০-১৫ জনের একটি দল এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তারা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্য হতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের মুঠোফোনে কল করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। এ ছাড়া ডিএমপির ঊর্ধ্বতন আরও তিন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনারকে একাধিকবার কল করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পরে এ নিয়ে কথা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পুরো পরিস্থিতিই অস্বাভাবিক। সে কারণে হয়তো এমন কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে মামলার স্বার্থে, সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে আসামি গ্রেপ্তার ও আলামত জব্দের প্রতিটি বিষয় সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *